ZAKAT
যাকাত বিধানের সারসংক্ষেপ
যাকাত
যাকাত বিধানের সারসংক্ষেপ
যাকাতের অর্থ
আরবী الزكاة ‘যাকাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি ও উন্নতি। যাকাত শব্দের আভিধানিক আরেকটি অর্থ হয় التطهير (তাতহির), যার বাংলা অনুবাদ পবিত্র করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩﴾ [الشمس: 9]
“সে নিশ্চিত সফল হয়েছে যে তাকে (নফসকে) পবিত্র করেছে”। [সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯]
যাকাতের কারণে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাই যাকাতকে যাকাত বলা হয়। যাকাতের কারণে নেকিও বর্ধিত হয়।
যাকাতের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও যাকাত না দেওয়ার পরিণতি
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٠٣﴾ [التوبة: 103]
“তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও, এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদের জন্য দো‘আ কর, নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿إِنَّ ٱلۡمُتَّقِينَ فِي جَنَّٰتٖ وَعُيُونٍ ١٥ ءَاخِذِينَ مَآ ءَاتَىٰهُمۡ رَبُّهُمۡۚ إِنَّهُمۡ كَانُواْ قَبۡلَ ذَٰلِكَ مُحۡسِنِينَ ١٦ كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ١٩﴾ [الذاريات: 15-19]
“নিশ্চয় মুত্তাকিরা থাকবে জান্নাতসমূহে ও ঝর্ণাধারায়, তাদের রব তাদের যা দিবেন তা তারা খুশীতে গ্রহণকারী হবে। ইতোপূর্বে এরাই ছিল সৎকর্মশীল। রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত। আর তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক”। [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১৫-১৯]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤﴾ [التوبة:34]
“যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদেরকে বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৪]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿وَلَا يَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ بِمَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ هُوَ خَيۡرٗا لَّهُمۖ بَلۡ هُوَ شَرّٞ لَّهُمۡۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِۦ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ ١٨٠﴾ [آل عمران:180]
“আল্লাহ যাদেরকে তার অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর, যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]
২. ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে ইয়ামান পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন:
«إنك تأتي قوماً من أهل الكتاب، فادْعُهُم إلى شهادة أنْ لا إله إلا الله، وأني رسول الله، فإنْ هم أطاعوا لذلك، فأعْلِمْهُم أن الله افترض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة، فإنْ هم أطاعوا لذلك، فأعْلِمْهُم أن الله افترض عليهم صدقة تُؤخَذ مِن أغنيائهم فتُرَدّ في فقرائهم، فإنْ هم أطاعُوا لذلك، فإيَّاكَ وَكَرَائِمُ أموالهم (يعني لا تأخذ الزكاة مِن أفضل أموالهم وأحَبّهَا إليهم كما سيأتي)، واتقِ دعوة المظلوم، فإنه ليس بينها وبين الله حِجاب».
“তুমি কিতাবিদের এক কওমের নিকট যাচ্ছ, অতএব, তাদেরকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আমি আল্লাহর রাসূল’ সাক্ষীর দিকে আহ্বান কর, যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, প্রত্যেক দিন ও রাতে আল্লাহ তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাদের ওপর সদকা ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের থেকে গ্রহণ করে তাদেরই গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে, যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তুমি তাদের দামী সম্পদ গ্রহণ করা পরিহার কর, (অর্থাৎ যে সম্পদ তাদের নিকট অতি উত্তম ও অধিক পছন্দনীয় যাকাত হিসেবে সেখান থেকে তুমি গ্রহণ করবে না, সামনে এ সম্পর্কে আলোচনা আসছে), আর মজলুমের দো‘আ থেকে বাঁচ। কারণ, তার মাঝে ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই”।[সহীহ বুখারী]
বিভিন্ন প্রকার যাকাত
বিভিন্ন প্রকার যাকাত রয়েছে, যেমন
স্বর্ণের যাকাত,
চেক ও ব্যাংক নোটের যাকাত,
যাকাতুল ফিতর,
ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত,
গুপ্তধনের যাকাত,
জীব-জন্তুর যাকাত,
ফল ও ফসলের যাকাত।
যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ
১ম শর্ত: ব্যক্তির স্বাধীন হওয়া
২য় শর্ত: মুসলিম হওয়া
৩য় শর্ত: সম্পদ নিসাব পরিমাণ হওয়া: শরী‘আত কর্তৃক সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণকে নিসাব বলা হয়। সম্পদ নির্দিষ্ট পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব।
৪র্থ শর্ত: নিসাব পরিমাণ সম্পদে হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া
প্রথম: অলঙ্কারের যাকাত
অলঙ্কার দু’প্রকার:
প্রথম প্রকার: নগদ মুদ্রা, অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপা। স্বর্ণ ও রূপার যাকাত সম্পর্কে আহলে ইলমগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন। কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন দেখতে হবে: স্বর্ণ-রূপা সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার জন্য, না সঞ্চয় করে রাখার জন্য, না ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজের জন্য। অধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে: নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যে উদ্দেশ্যেই তা সংগ্রহ করুক। কারণ যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দলীল সবপ্রকার স্বর্ণ-রূপাকে শামিল করে, কোনো প্রকার স্বর্ণ-রূপা যাকাত থেকে বাদ দেওয়া হয় নি। তাই বলে যারা বলেন ব্যবহার করার স্বর্ণ-রূপার ওপর যাকাত ফরয নয়, তাদের কথাকে মূল্যহীন জ্ঞান করছি না, যেহেতু এটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ মাসআলা, তাতে দ্বিমত করার সুযোগ আছে।
জ্ঞাতব্য: নারীর মালিকানাধীন স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি তার নিকট যাকাত দেওয়ার অর্থ না থাকে, যাকাত পরিমাণ অলঙ্কার বিক্রি যাকাত দিবে। কেউ যদি তাকে যাকাতের ক্ষেত্রে সাহায্য করে, যেমন স্বামী বা নিকট আত্মীয় তবে তাতে কোনোও সমস্যা নেই।
দ্বিতীয় প্রকার: স্বর্ণ-রূপা ব্যতীত অন্যান্য বস্তু যেমন হীরা, মুক্তা, ইয়াকুত, মোতি, মুক্তোদানা, গোমেদ-পীতবর্ণ মণিবিশেষ ইত্যাদি বস্তুর ভেতর যাকাত ওয়াজিব হয় না; তার মূল্য যাই হোক, তবে ব্যবসার জন্য হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।
স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের নিসাব
স্বর্ণের নিসাব: স্বর্ণের নিসাব বিশ দিরহাম স্বর্ণ, যা ওজন করলে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ হয়। কারও মালিকানাধীন যদি ৮৫ গ্রাম বা ততোধিক স্বর্ণ থাকে, ক্যারেট যাই হোক, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যাকাতের পরিমাণ এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট স্বর্ণের ২.৫ পার্সেন্ট।
রূপার নিসাব: ২০০ দিরহাম রূপা, যা ওজন করলে ৫৯৫ গ্রাম হয়। কারও মালিকানায় যদি ২০০ দিরহাম বা তার চেয়ে বেশি রূপা থাকে এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তবেই তাতে যাকাত ফরয হবে। যাকাতের পরিমাণ: এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট রূপার ২.৫%।
দ্বিতীয়: ব্যাংক নোটের যাকাত
ব্যাংক নোট যেমন ডলার, জুনাই, রিয়াল ও অন্যান্য মুদ্রা, যা নগদ অর্থ হিসেবে পরিচিত। অনুরূপ অর্থের বিভিন্ন দলীল, যেমন চেক, বিল, বিনিয়োগ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র, যার বৈষয়িক মূল্য রয়েছে।
জ্ঞাতব্য যে, ব্যাংক নোট ও চেক মূলত তার মূল্যের দলীলস্বরূপ, অতএব, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। প্রতি হাজারে পঁচিশ টাকা যাকাত আসবে।
ঋণের যাকাত
আলিমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন যে, মানুষের নিকট যার যাকাতের নিসাব পরিমাণ ঋণ বা পাওনা আছে এবং সে ঋণের ওপর হিজরী এক বছরও পূর্ণ হয়েছে, তার যাকাত বের করা কি ওয়াজিব?
আলিমদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ঋণের ওপর যাকাত নেই, ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত বা অনিশ্চিত যাই হোক। ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ স্বীকার করে, ভবিষ্যতে অস্বীকার করবে না এবং তার থেকে উসুল করাও সম্ভব। ঋণ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ অস্বীকার করে অথবা গরীব-ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য তার নেই অথবা ঋণ নিয়ে টালবাহানাকারী। এসব ক্ষেত্রে যাকাত নেই। কারণ, ঋণ তার পূর্ণ আয়ত্তে নেই, সে তাতে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে না, যেহেতু তার কাছে নেই, তবুও যারা বলেন, ঋণের ওপর যাকাত ফরয তাদের মতকে মূল্যহীন বলি না।
তৃতীয়: ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত
অর্থাৎ যেসব বস্তু দিয়ে ব্যবসা করা হয়, যেমন ব্যবসার নানা পণ্য, জমি, গাড়ি ও ব্যবসার অন্যান্য সামগ্রী। অধিকাংশ আলিম বলেন: ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব। এটিই বিশুদ্ধ মত।
ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ:
ক. মালিকানা পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবসায়ী পণ্যের পূর্ণ মালিক হওয়া, যেমন ক্রয় বা হেবা বা মিরাস বা অন্য কোনোভাবে ব্যবসায়ী পণ্যের পূর্ণ মালিক হওয়া। এটিই বিশুদ্ধ মত। অতএব, কেউ যদি ব্যবসায়ী পণ্যের আমানতদার বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা জিম্মাদার হয় তার ওপর যাকাত ফরয হবে না।
খ. ব্যবসায়ী পণ্যের উদ্দেশ্য ব্যবসা হওয়া, যদি জমা ও ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে সম্পদের মালিক হয়, ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না।
গ. ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য স্বর্ণ বা রূপার নিসাব সমপরিমাণ হওয়া,
ঘ. ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া।
কয়েকটি জরুরি বিষয়:
উদাহরণত কেউ যদি গাড়ি অথবা নিজের ব্যবহারের জন্য জমি অথবা বাড়ি নির্মাণ করার জন্য খরিদ করে, যা দিয়ে তার ব্যবসার নিয়ত ছিল না, অতঃপর প্রয়োজন না থাকায় অথবা অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সেটি বিক্রি করে দেয়, এতে উক্ত গাড়ি ও জমি ব্যবসায়ী পণ্য হবে না। কারণ, এগুলো ব্যবসার জন্য খরিদ করা হয় নি। অতএব, তাতে যাকাত নেই। আর যদি নিজের সংগ্রহে রাখার জন্য কোনও বস্তু খরিদ করে অতঃপর সেটি দিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যখন থেকে ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিবে তখন থেকে ব্যবসায়ী পণ্য হবে। তার নিসাব পরিমাণ মূল্যের ওপর যদি হিজরী এক বছর পূর্ণ হয় যাকাত ওয়াজিব হবে।
ব্যবসায়ী পণ্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, প্রতি হিজরী বছর তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন, এটিই বিশুদ্ধ। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জ্ঞাতব্য:
ক. যদি কারও নিকট ঋণ থাকে তার ওপর যাকাত নেই। এটি বিশুদ্ধ মত।
কেউ যদি ঋণগ্রস্ত হয়, আর বছর শেষে ঋণ পরিশোধ করার সময় হয়, তবে আগে ঋণ দিবে, ঋণের যাকাত তার ওপর নেই। যদি ঋণ পরিশোধ করার সময় না হয়, তাহলে ঋণ এবং ঋণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করে যাকাত দিবে, কারণ তার মালিকানায় থাকা সকল সম্পদের যাকাত দেওয়া তার ওপর ওয়াজিব।
চলতি বছর ট্যাক্স, কাস্টমস, কর্মচারীদের বেতন, ঘর ভাড়া, ব্যক্তিগত ও সংসার খরচ বাবদ যা ব্যয় হয়েছে তার ওপর যাকাত নেই।
জ্ঞাতব্য যে, ব্যবহারের আসবাব-পত্রে যাকাত নেই, অর্থাৎ যে ঘরে ব্যবসায়ী পণ্য রাখা হয় সে ঘরের যাকাত নেই। কারণ যাকাত ওয়াজিব হয় ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর। হ্যাঁ, কেউ যদি ঘরের ব্যবসা করে এবং এক বা একাধিক ঘরের মূল্য যাকাতের নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে, যদি হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়। অনুরূপ যেসব আসবাব-পত্র মূলধন, যেমন উৎপাদন যন্ত্র, মেশিন ও পরিবহন গাড়ি ইত্যাদির ওপর যাকাত নেই। অনুরূপ ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সির ওপর যাকাত নেই, তবে তার মুনাফায় যাকাত ওয়াজিব, যদি তার নিসাব পরিমাণ মুনাফার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়।
দু’জন ব্যক্তি এক পণ্যের ব্যবসা করে, তাদের কারও অংশই নিসাব পরিমাণ নয়, কিন্তু দু’জনের অংশ যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, এমতাবস্থায় তাদের কারও ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না তাদের প্রত্যেকের অংশ যাকাতের নিসাব সমপরিমাণ হবে। হ্যাঁ, দু’জন থেকে যার অংশ নিসাব পরিমাণ হবে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, অপরের ওপর নয়।
চতুর্থ: গুপ্তধনের যাকাত
প্রথমত: গুপ্তধনের সংজ্ঞা: অধিকাংশ আলিম বলেছেন, —আর তাদের সংজ্ঞাটিই বিশুদ্ধ: গুপ্তধন বলতে জমিনে পুতে রাখা সকল সম্পদকে বুঝানো হয়, যেমন প্রত্নতত্ত্ব, স্বর্ণ, রূপা, সীসা, পিতল, বাসন-কোসন ও অন্যান্য আসবাব-পত্র, তবে জাহিলি যুগের হওয়া শর্ত, অর্থাৎ নিশ্চিত হতে হবে যে, গুপ্তধন ইসলামের পূর্বযুগে মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে, (গুপ্তধনের গায়ের তারিখ ও অন্যান্য নিদর্শন দেখে যা বুঝা যায়) অতঃপর কেউ নিজের জমি খনন করতে গিয়ে তার সন্ধান পায়। যেমন, ঘরের খুঁটি অথবা কুপ অথবা কোনও খনন কাজে বেরিয়ে আসে। আর যদি গুপ্তধন বের করতে টাকা-পয়সা ব্যয় হয় তখন সেটি গুপ্তধন থাকবে না, যাকাতের সম্পদের ন্যায় সাধারণ সম্পদ গণ্য হবে, যেমন পূর্বে বলেছি।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যদি এই জমি, (যেখানে গুপ্তধন পাওয়া গেছে) কারও থেকে ক্রয় করা হয়, আর গুপ্তধনে প্রমাণ থাকে যে, যার থেকে জমি ক্রয় করা হয়েছে তারই এই সম্পদ, তখন বিক্রেতাকে সম্পদ ফেরত দেওয়া জরুরি, আর তখন সে ব্যক্তিই তার যাকাত দিবে। অনুরূপ জমি যদি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন হয়, আর রাষ্ট্র কাউকে লিজ বা ভাড়া দেয়, তাহলে রাষ্ট্রকে গুপ্তধন ফেরত দেওয়া জরুরি, রাষ্ট্র তার যাকাত দিবে।
আর যদি জানা যায় গুপ্তধন ইসলাম বিকাশ লাভ করার পর মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে, তাহলে এই প্রাপ্তধন গুপ্তধন হবে না, বরং কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদ হবে, অর্থাৎ কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদের ন্যায় গণমাধ্যমে তার এক বছর ঘোষণা দিবে, (অমুক সম্পদ অমুক জায়গায় পাওয়া গেছে) যেন মালিক পর্যন্ত ঘোষণা পৌঁছে যায়, যদি নিদর্শন দ্বারা মালিকের পরিচয় পাওয়া যায় তবে তাকে ফেরত দেওয়া ওয়াজিব, অন্যথায় সে নিজেই তার মালিক হবে এবং নিসাব বরাবর হলে তার যাকাত দিবে, কারণ এটি জাহিলি যুগের গুপ্তধন নয়।
দ্বিতীয়ত: গুপ্তধন থেকে যাকাত দেওয়ার পরিমাণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: وفي الرِّكَاز: الخُمس “গুপ্তধনের যাকাত এক পঞ্চমাংশ”।[সহীহ বুখারী] অর্থাৎ যে গুপ্তধন পাবে সে গুপ্তধন থেকে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিবে। অধিকাংশ আলিম বলেছেন: যে গুপ্তধন পাবে তার দায়িত্ব এক পঞ্চমাংশ যাকাত বের করা, সে মুসলিম হোক বা মুসলিম দেশে বসবাসকারী যিম্মি হোক।
তৃতীয়ত: গুপ্তধনের নিসাব: হাদীসের বাহ্যিক অর্থ বলে, গুপ্তধনে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নিসাব শর্ত নয়। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন। অতএব, যে জাহিলি যুগের গুপ্তধন পাবে, সে তার এক পঞ্চমাংশ যাকাত দিবে, তার পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক।
পঞ্চম: চতুষ্পদ প্রাণীর যাকাত
এ অধ্যায় দ্বারা উদ্দেশ্য উট, গরু ও বকরির যাকাত। কারণ, এসব প্রাণী ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীর যাকাতের কথা হাদীসে উল্লেখ নেই। অতএব, সাধারণ পাখি, মুরগি, ঘোড়া, গাধা, খরগোশ ও অন্যান্য প্রাণীতে যাকাত নেই, তার সংখ্যা যত বেশি হোক, তবে কোনও প্রাণী ব্যবসার জন্য নির্ধারিত হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। চতুষ্পদ প্রাণীর যাকাতের জন্য শর্তসমূহ:
১. নিসাব পরিমাণ হওয়া, যার ব্যাখ্যা সামনে আসছে।
২. হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া।
৩. যাকাতের পশু সায়েমা হওয়া।
পশু যদি মালিকের কেটে আনা ঘাস খায়, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না, অধিকাংশ আলেমের মত এটি। আর যদি ব্যবসার জন্য পশু লালন-পালন করা হয় ব্যবসার পণ্য হবে, তাদের লালন-পালন যেভাবেই হোক না কেন। তবে লক্ষণীয় যে, কেউ যদি নিজের জমি চাষ করার জন্য পশু পালন করে তাতে যাকাত নেই, কারণ এগুলো সায়েমা নয়, গৃহপালিত পশুও ব্যবহারের আসবাব-পত্রের ন্যায়। আলিমদের বিশুদ্ধ মত এটি। কারণ সায়েমা পশুর ওপর যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ যেসব পশু মাঠে-জঙ্গলে ও পাহাড়ে চরে বেড়ায় এবং বছরের অধিকাংশ দিন প্রাকৃতিক ঘাস ও তৃণলতা খায় সেসব পশুই কেবল ‘সায়েমা’।
নিম্নে উট, গরু ও বকরির যাকাতের নিসাব ও তার পরিমাণ দেওয়া হল:
ক. সায়েমা উটে যাকাতের নিসাব ও তার পরিমাণ শরী‘আত নির্ধারণ করে দিয়েছে, নীচের চার্টে দেখুন:
উটের সংখ্যা - যাকাতের পরিমাণ
১-৪ - যাকাত নেই, চাইলে নফল সদকা করবে।
৫-৯ - একটি বকরি: ছাগল বা মেষ
১০-১৪ - দু’টি বকরি
১৫-১৯ - তিনটি বকরি
২০-২৪ - চারটি বকরি, মালিকের সুবিধা হলে চারটি বকরির স্থানে একটি উট দিবে।
২৫-৩৫ - বিনতু মাখাধ মাদী: দ্বিতীয় বছরের উটনী।
৩৬-৪৫ - বিনতু লাবুন মাদী: তৃতীয় বছরের উটনী।
৪৬-৬০ - একটি হিক্কাহ: চতুর্থ বছরের উটনী।
৬১-৭৫ - একটি জিয‘আহ: পঞ্চম বছরের উটনী।
৭৬-৯০ - দু’টি বিনতু লাবুন।
৯১-১২০ - দু’টি হিককাহ।
জ্ঞাতব্য: উটের সংখ্যা যদি (১২০) থেকে বেশি হয়, তখন প্রত্যেক ৪০ অংকের জন্য একটি বিনতু লাবুন এবং প্রত্যেক পঞ্চাশ অংকের জন্য একটি হিক্কাহ যাকাত দিবে। উট যত বেশি হোক এভাবে (৪০ ও ৫০) দু’টি সংখ্যায় ভাগ করবে, যেমন:
উট সংখ্যা - ৪০ ও ৫০ সংখ্যা = যাকাতের পরিমাণ
১৩০=(২*৪০)+(৫০) = ২ বিনতু লাবুন ও ১ হিককাহ
১৪০=(২*৫০)+(৪০)= ২ হিককাহ ও ১ বিনতু লাবুন
১৫০=(৩*৫০)= ৩ হিককাহ
১৬০=(৪*৪০)= ৪ বিনতু লাবুন
১৭০=(৩*৪০)+(৫০)= ৩ বিনতু লাবুন ও ১ হিককাহ
১৮০=(২*৫০)+(২*৪০)= ২ হিককাহ ও ২ বিনতু লাবুন
১৯০=(৩*৫০)+(৪০)= ৩ হিককাহ ও ১ বিনতু লাবুন
২০০=(৪*৫০)= অথবা ২০০=(৫*৪০)= ৪ হিককাহ অথবা ৫ বিনতু লাবুন
খ. বকরির যাকাত: বকরির নিসাব নর বা মাদী ৪০টি বকরি। বকরি মেষকেও শামিল করে। অতএব, বকরি ও মেষের যাকাত নিম্নরূপ:
বকরি / মেষের সংখ্যা - যাকাতের পরিমাণ
১-৩৯ - যাকাত নেই, চাইলে সদকা করবে।
৪০-১২০ - ১ বকরি।
১২১-২০০ - ২ বকরি।
২০১-৩০০ - ৩ বকরি।
বকরি যদি ৩০০ থেকে অধিক হয়, প্রতি একশো থেকে একটি বকরি যাকাত দিবে। অর্থাৎ বকরি ৪০০ হওয়ার আগে চারটি বকরি ওয়াজিব হবে না, অতএব, ৩৯৯টি বকরি পর্যন্ত তিনটি বকরি ওয়াজিব হবে, বকরির সংখ্যা যখন ৪০০ হবে ৪টি বকরি ওয়াজিব হবে ৪৯৯টি পর্যন্ত। এভাবে উপরের দিকে অগ্রসর হবে।
গ. গরুর যাকাত: গরুর যাকাতের নিসাব ৩০টি গরু। নর-মাদী উভয় প্রকার কিংবা শুধু মাদী বা শুধু নর যাই হোক ৩০টি গরু হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। নিসাব পরিমাণ গরুর ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে একটি তাবি বা তাবি‘আহ অর্থাৎ এক বছরের নর বা মাদী গরু যাকাত দিবে। তারপর প্রতি ৪০টি গরু থেকে একটি মুসিন্নাহ অর্থাৎ দুই বছরের গরু যাকাত দিবে। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন। গরু যত বেশি হোক ৩০ ও ৪০ দু’টি সংখ্যায় অর্থাৎ তিন দশক ও চার দশক করে ভাগ করবে:
গরুর সংখ্যা - যাকাতের পরিমাণ
১-২৯ - যাকাত নেই
৩০-৩৯ - ১টি তাবি বা তাবিআহ (১ বছরের গরু)
৪০-৫৯ - ১টি মুসিন্নাহ (২-বছরের গরু)
৬০=(৩০*২)= দু’টি তাবি/তাবিআহ (নর-মাদী)
৭০=(৩০+৪০)= ১টি তাবিআহ ও ১টি মুসিন্নাহ
১০০=(৩০*২)+৪০= ২টি তাবিআহ ও ১টি মুসিন্নাহ
আরেকটি মাসআলা জানা জরুরি যে, যদি মনে করি কারও ৬৫ টি গরু আছে, সে ৬০টি গরুর যাকাত দিবে, পূর্বে বলেছি, ষাটের অতিরিক্ত ৫টি গরুর যাকাত নেই।
ষষ্ঠ: ফল ও ফসলের যাকাত
১. কোন কোন ফসলের ওপর যাকাত ওয়াজিব?
হাদীসে যেসব ফসলের নাম উল্লেখ করে যাকাত নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো চার প্রকার: ক. الحِنطة বা গম, খ. الشعير বা যব, গ. التمر বা খেজুর, ও ঘ. الزبيب বা কিশমিশ।
জ্ঞাতব্য যে, এই চার প্রকার ব্যতীত অন্যান্য ফল ও ফসলে যাকাত ওয়াজিব হবে কি না আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন, বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, (আল্লাহ ভালো জানেন) যেসব ফল ও ফসল খাদ্য ও সঞ্চয় করার উপযুক্ত তাতে যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করলে নষ্ট হয় না, যেমন ভুট্টা, চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য। অতএব, শাক-সবজি, জয়তুন ও ফলের ভেতর যাকাত নেই, কাঁচা খেজুর ব্যতীত [কারণ তা সঞ্চয় করা যায়], অনুরূপ আঙ্গুর ব্যতীত। কারণ, আঙ্গুর সঞ্চয় [করা যায়, তা সঞ্চয়] করলে কিশমিশ হয়।
ফল ও ফসলের যাকাতের নিসাব: অধিকাংশ আলিম বলেছেন: ফল ও ফসলের নিসাব পাঁচ ওসাক, যা সাধারণত ৬৪৭ কেজি হয়।
ফসলে যাকাতের পরিমাণ: দশ ভাগের একভাগ ফসল যাকাত দেওয়া ওয়াজিব, অর্থাৎ মোট ফল ও ফসলের ১০% যাকাত দিবে, যদি প্রাকৃতিক সেচ দিয়ে বিনা খরচে ফসল উৎপন্ন হয়, যেমন নদী-খাল ও বৃষ্টির পানির ফসল। অনুরূপ যে গাছগাছালি লম্বা শিকড় দিয়ে দূর থেকে পানি চুষে নেয়, সেচ করার প্রয়োজন হয় না তার হুকুমও এক, যেমন খেজুর গাছ। আর যদি ফল ও ফসলের জমি টাকা খরচ করে সেচ করা হয়, যেমন মেশিন দিয়ে সেচ করা হয়, তার ৫% অর্থাৎ এক দশমাংশের অর্ধেক বা বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিবে। চার ইমামের মাযহাব এটি, এতে কেউ দ্বিমত করেন নি।
ফল ও ফসলের যাকাত দেওয়ার সময়: বিশুদ্ধ মতে, ফল যখন ব্যবহার উপযোগী হয় ও পেকে যায়, যেমন ফলের আঁটি শক্ত বা খেজুর লাল হয়, তখন তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, তবে যখন ফসল খোসা থেকে পরিস্কার করবে বা তাতে মেশিন লাগাবে, তখন আদায় করবে, অনুরূপ খেজুর শুকানোর পর তার যাকাত দিবে।
যাকাতের হকদার
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٦٠﴾ [التوبة: 60]
“নিশ্চয় সদকা হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, (তা আরও বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়”।[সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬] এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের হকদার আট প্রকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, নিম্নে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেখুন:
যাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় হকদার:
ফকীর ও মিসকীন: ফকীর ও মিসকীন শব্দ দু’টির পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছন, সংজ্ঞা যাই বলা হোক তারা অর্থাৎ ফকীর ও মিসকীন যাকাতের হকদার। সারকথা হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীন তাদেরকে বলা হয়, যাদের সম্পদ ও সম্পদ উপার্জন করার উপায় নেই। অনুরূপ কারও সম্পদ ও সম্পদ উপার্জন করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু তা দিয়ে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জরুরি প্রয়োজন পূরণ হয় না, যেমন খাবার, পোশাক, বাড়ি-ভাড়া, চিকিৎসা খরচ, অপারেশন, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল ইত্যাদি তার সম্পদ দিয়ে যথেষ্ট হয় না।
যাকাতের তৃতীয় হকদার:
যাকাতের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ: যাকাতের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা উদ্দেশ্য যাকাত উসুলকারীগণ। অর্থাৎ বিত্তশালীদের নিকট থেকে যাকাত উসুল করার জন্য খলিফা বা তার প্রতিনিধি যাদেরকে নিয়োগ দেন তারাই যাকাত উসুলকারী। অনুরূপ যাকাত সংরক্ষণকারী, অর্থাৎ যারা গুদামে সংরক্ষিত যাকাত রক্ষণা-বেক্ষণ করেন। অনুরূপ যারা গরীবদের মাঝে যাকাত বণ্টন করার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদেরকে যাকাত থেকে দেওয়া বৈধ, যদিও তারা ধনী হয়। এটি তাদের বৈধ হক, যা শরী‘আত তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, তারা যদি এই হক ত্যাগ করে সমস্যা নেই।
যাকাতের চতুর্থ হকদার:
যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা জরুরি, তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ। যাদেরকে যাকাত দিলে ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা যাদেরকে যাকাত দিলে ঈমান শক্তিশালী হবে অথবা যাদেরকে যাকাত দিলে মুসলিমদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকবে, তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ, তারা সবাই এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য যে, ইয়াহূদি-খ্রিস্টান ধর্ম থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তারাও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত।
যাকাতের পঞ্চম হকদার:
গোলাম মুক্ত করা: আরবি رقاب শব্দটি বহুবচন, একবচন رقبة যার অর্থ দাস-দাসী। আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী "وفي الرقاب" দ্বারা উদ্দেশ্য দাস-দাসীকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। আয়াতের উদ্দেশ্য দাস-দাসীকে সম্পদ দেওয়া নয়, বরং তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা উদ্দেশ্য।
যাকাতের ষষ্ঠ হকদার:
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: আরবী غارمون বহুবচন, একবচন হচ্ছে غارم অর্থাৎ ঋণগ্রস্ত মুসলিম। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি দু’প্রকার:
এক. মানুষের মাঝে সুসম্পর্ক পুণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য খরচ করে যিনি ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। যেমন কেউ বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া বিবাদের মীমাংসার জন্য নিজের জিম্মাদারীতে কিছু সম্পদের দায়িত্ব গ্রহণ করে যাতে সম্পদ প্রদান করতে হয়। যেমন এক পক্ষকে কিছু টাকা দিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া। অথবা যদি এমন কোনো নগদ টাকা ব্যয় করে খাবারের আয়োজন করে যাতে উভয় বিবদমান পক্ষকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মাঝে মীমাংসা করার ব্যবস্থা করা হয়। অথবা উভয় বিবদমান গোষ্ঠীর জন্য হাদীয়া ক্রয় ও তা প্রদানের মাধ্যমে সম্প্রীতির ব্যবস্থা করে দেওয়া। সুতরাং যারা এ কাজ করার জন্য ঋণ করবে তারা ধনী হলেও তাদেরকে যাকাতের সম্পদ দেওয়া যাবে এ কাজকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য।
দুই. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: অর্থাৎ যে নিজের প্রয়োজনে ঋণ করেছে, যেমন অভাব অথবা চিকিৎসা অথবা পোশাক-পরিচ্ছদ অথবা বিবাহ অথবা ঘরের আসবাব-পত্র কেনার জন্য ঋণ করেছে, (পুরনো ফার্নিচার নতুন করার জন্য ঋণ করলে এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না)। অনুরূপ যার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে সেও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত, যেমন অগ্নিকাণ্ড অথবা জলোচ্ছ্বাস অথবা মাটিতে ধসে যাওয়া ইত্যাদি।
যাকাতের সপ্তম হকদার:
ফী সাবীল্লিাহ বা আল্লাহর রাস্তার যাত্রীগণ: আল্লাহর রাস্তা দ্বারা উদ্দেশ্য জিহাদ। অতএব, মুজাহিদ ও মুজাহিদদের অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য যাকাত খরচ করবে, যদিও তারা ধনী হয়। অতএব, গোলাবারুদ ও অস্ত্র-শস্ত্র খরিদ করা, যুদ্ধের বিমান ঘাটি তৈরি করা, শত্রুদের সন্ধান দাতার বেতন ইত্যাদি এই খাতের অন্তর্ভুক্ত।
আরেকটি প্রসঙ্গ: ইবন উমার ও ইবন আব্বাস এবং ইমাম আহমদ, হাসান, ইসহাক ও শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া প্রমুখগণ বলেন: হজ এই খাতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, হজ আল্লাহর রাস্তায় এক প্রকার জিহাদ, যেমন হাদীসে প্রমাণিত:
«أفضلَ الجهاد حَجٌّ مبرور».
“সর্বোত্তম জিহাদ মাবরুর হজ”।[সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫২০]
ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইসলামের ফরয হজ করে নি অভাবের কারণে, তাকে হজ করার পরিমাণ যাকাত দেওয়া বৈধ”।
‘ফি সাবিলিল্লাহ’ যেহেতু বিশুদ্ধ মতে কেবল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকেই বুঝায়, সেহেতু মসজিদ তৈরি, রাস্তা সংস্কার ও কিতাব ছাপানোর জন্য যাকাত খরচ করা বৈধ নয়, বরং তার জন্য অন্যান্য খাত থেকে খরচ করবে, যেমন ওয়াকফ, হেবা, ওসিয়ত ও সদকা ইত্যাদি।
যাকাতের অষ্টম হকদার:
ইবনুস সাবিল বা মুসাফির: ইবনুস সাবিল অর্থ মুসাফির, অর্থাৎ যার রাহ খরচ নেই। রাহ খরচ হারিয়ে গেছে অথবা ফুরিয়ে গেছে অথবা কোনও বিপদের কারণে তার অর্থ প্রয়োজন। এরূপ ব্যক্তিকে সফর পূর্ণ করে দেশে ফিরার জন্য যাকাত দেওয়া বৈধ, যদিও সে নিজ দেশে ধনী।
যাকাত সংক্রান্ত কয়েকটি মাসআলা - ১
১. স্ত্রী যদি ধনী হয় এবং তার নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, সে কি ফকীর স্বামীকে যাকাত দিবে?
উত্তর: হ্যাঁ, স্ত্রীর জন্য তার গরীব স্বামীকে সদকা দেওয়া বৈধ, সেটি যাকাতের ন্যায় ওয়াজিব সদকা হোক বা নফল সদকা। আলিমদের এটিই বিশুদ্ধ মত, বরং স্বামীকে সদকা দেওয়া অপরকে সদকা দেওয়া অপেক্ষা উত্তম, কারণ সে দু’টি সাওয়াব পাবে: আত্মীয়তা রক্ষা ও সদকার সাওয়াব।
২. পিতা-মাতা, সন্তান ও স্ত্রীকে যাকাত দেওয়ার বিধান: নিজের স্ত্রীকে স্বামীর যাকাত দেওয়া বৈধ নয়, যদিও সে গরীব হয়। কারণ, স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর, তাই স্বামীর কারণে স্ত্রী যাকাতের মুখাপেক্ষী নয়। অনুরূপ স্ত্রীর মতই পিতা-মাতা, সন্তান, দাদা-দাদী ও নাতি-নাতনি, তারা ফকীর হলেও তাদের যাকাত দেওয়া বৈধ নয়। তারা যদি ঋণী অথবা আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ অথবা মুসাফির হয় তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ, তারা তখন যাকাতের হকদার অন্য কারণে, আত্মীয়তা তাতে বাঁধ সাধবে না। কারণ, তাদেরকে যুদ্ধে পাঠানোর ব্যবস্থা করা তার ওপর জরুরি নয় অথবা তাদের ঋণ পরিশোধ করা কিংবা তাদের অন্যান্য খরচ বহন করা তার দায়িত্ব নয়। তার দায়িত্ব শুধু তাদের ভরণ-পোষণ করা, যথা অর্থনৈতিক সামর্থ্য মোতাবেক খাবার, বাসস্থান ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا مَآ ءَاتَىٰهَاۚ ٧﴾ [الطلاق: 7]
“আল্লাহ কাউকে যা দিয়েছেন সেটার আওতার বাইরে দায়িত্ব দেন না”। [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত: ৭]
এ ছাড়া অন্যান্য আত্মীয় যেমন ভাই, বোন, চাচা, মামা এবং বিবাহিত ছেলে, যার সংসার পিতার সংসার থেকে পৃথক, যদি তাদের উপার্জন তাদের নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য যথেষ্ট না হয় তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ। অনুরূপ যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপর রয়েছে সে যদি যাকাতের আট খাত থেকে কোনও এক-খাতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ, কারণ সে যাকাতের হকদার, বরং অন্যদের অপেক্ষা তাকে যাকাত দেওয়া উত্তম।
৩. কাফিরদের যাকাত দেওয়ার বিধান: ইসলামের সাথে বিদ্বেষ পোষণকারী কাফিরদের যাকাত দেওয়া বৈধ নয়, অনুরূপ জিম্মিদেরকেও যাকাত দেওয়া বৈধ নয়, অর্থাৎ যেসব অমুসলিম নিরাপত্তার চুক্তি নিয়ে মুসলিম দেশে বাস করে, বিশুদ্ধ মতে তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ নয়, তবে সদকা ও অন্যান্য দান দেওয়া বৈধ।
জ্ঞাতব্য, যার ওপর যাকাত ফরয তার উচিৎ যাকাত বণ্টনের জন্য নেককার ও আহলে ইলমদের প্রাধান্য দেওয়া, যেন তারা আল্লাহর আনুগত্য ও ইলম চর্চা করতে সক্ষম হয়। যে পাপ ও গুনাহের কাজে যাকাত খরচ করবে তাকে যাকাত দেওয়া বৈধ নয়। কারণ, তাকে যাকাত না দেওয়া পাপ বন্ধ করার একটি উপায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ ٢﴾ [المائدة: 2]
“তোমরা পাপ ও গুনাহের ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য কর না”। [সূরা আল-মায়েদাহ্, আয়াত: ২]
যার সম্পর্কে ভালো-মন্দ জানা নেই, তাকে যাকাত দিতে সমস্যা নেই। কারণ, অপর সম্পর্কে ভালো ধারণা করাই ইসলামের নীতি, যদি তার বিপরীত স্পষ্ট না হয়। অনুরূপ কারও সম্পর্কে যদি জানা যায় সে ফাসিক, তাকে ভালো করার জন্য যাকাত দিতে বাধা নেই। কারণ, দীনের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে আল্লাহ যাকাতে অংশ রেখেছেন, যা পূর্বে বর্ণনা করেছি।
৪. উপযুক্ত হকদারকে যাকাত দেওয়ার চেষ্টা করার পরও যদি কারও যাকাত এমন লোকের হাতে যায়, যে তার হকদার নয়, তার বিধান কী?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: জনৈক ব্যক্তি বলল:لأتصدقنَّ بصدقة (আজ আমি অবশ্যই সদকা করব), অতঃপর সে তার সদকা নিয়ে বের হলো, তার সদকা পড়ল জনৈক চোরের হাতে, সকাল বেলা লোকেরা বলাবলি করল: আজ রাতে চোরকে সদকা করা হয়েছে। সে বলল: اللهم لك الحمد، لأتصدقنَّ بصدقة (হে আল্লাহ তোমার জন্যই সকল প্রশংসা, আমি অবশ্যই সদকা করব)। সে তার সদকা নিয়ে বের হল, তার সদকা পড়ল জনৈক ব্যভিচারীর হাতে। মানুষেরা সকাল বেলা বলাবলি করল: আজ রাত ব্যভিচারীকে সদকা করা হয়েছে। সে আবার বলল: اللهم لك الحمد: على زانية!، لأتصدقنَّ بصدقة (হে আল্লাহ, তোমার জন্য সকল প্রশংসা, ব্যভিচারী সদকা পেল! আমি অবশ্যই সদকা করব)। সে তার সদকা নিয়ে বের হল, তার সদকা পড়ল জনৈক ধনীর হাতে, তারা সকাল বেলা বলাবলি করল: আজকে ধনীকে সদকা করা হয়েছে। অতঃপর সে বলল:
«اللهم لك الحمد: على سارق، وعلى زانية، وعلى غني!!».
“হে আল্লাহ, তোমার জন্যই সকল প্রশংসা, চোরের হাতে সদকা, ব্যভিচারীর হাতে সদকা ও ধনীরে হাতে সদকা। তাকে (স্বপ্নে) হাযির করে বলা হল: চোরের ওপর তোমার সদকার কারণ হয়তো সে চুরি থেকে বিরত থাকবে। ব্যভিচারিণীর ওপর তোমার সদকার কারণ হয়তো সে ব্যভিচার থেকে বিরত থাকবে, আর ধনীর ওপর তোমার সদকার কারণ হয়তো সে উপদেশ নিয়ে আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকে সদকা করবে”।[সহীহ বুখারী ]
৫. কাউকে যাকাত দেওয়ার সময় যাকাত বলা কি জরুরি? এতে আহলে ইলমগণ ইখতিলাফ করেছেন: যাকাত বলা জরুরি নয় মতটি অধিক বিশুদ্ধ; যখন এটা স্পষ্ট হবে যে লোকটি যাকাত নেওয়ার উপযুক্ত।
৬. কারও সম্পদ যদি বছরের মাঝখানে ধ্বংস হয়। যেমন, ক্ষতিগ্রস্ত হল অথবা কেউ আত্মসাৎ করল অথবা কেউ তার মাঝে ও তার সম্পদের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল, এই অবস্থায় তার ওপর যাকাত নেই। কারণ, আত্মসাৎ করা, ধ্বংস হওয়া বা ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদের যাকাত দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই, এই অবস্থায় যদি তাকে যাকাত দিতে বলা হয় তার জন্য কঠিন ঠেকবে, যা আল্লাহ দূর করে দিয়েছেন, তিনি বলেছেন:
﴿وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ٧٨﴾ [الحج: 78]
“আর তিনি দীনের ভিতর কোনো সংকীর্ণতা বা সমস্যা রাখেন নি”। [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৭৮]
৭. মূল সম্পদ থেকে পৃথক করার পর যাকাত ধ্বংস হলে করণীয় কি?
যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর মূল সম্পদ থেকে পৃথক করা রাখা হয়, অতঃপর তা ধ্বংস বা চুরি হয়, যদিও তা হয় যাকাত বণ্টনের জন্য নিয়ে সাওয়ার পথে, পুনরায় তাকে যাকাত দিবে হবে, কারণ তার জিম্মায় যাকাত বাকি আছে। এটি আলিমদের বিশুদ্ধ মত। ইবন হাযম জাহিরির মাযহাবও এটি। তিনি বলেছেন: “কারণ, যাকাত তার জিম্মায় রয়ে গেছে, আল্লাহ যাকে যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তার নিকট সে পৌঁছে দিবে”।
৮. যাকাত দ্বারা যদি ফকীরদের প্রয়োজন পূরণ না হয়, তাদেরকে নফল সদকা দেওয়া ধনীদের ওপর ওয়াজিব, যেমন খাদ্য-শস্য, পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থান ইত্যাদি। এ কথার সপক্ষে ইবন হাযম রহ. একাধিক দলীল পেশ করেছেন[1], যথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«أطعِمُوا الجائع، وَعُدُوا المريض، وفكوا العاني (أي: الأسير)».
“তোমরা ক্ষুধার্তকে খাবার দাও, রোগীকে দেখতে যাও এবং বন্দীকে মুক্ত কর”।[সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৩৭৩]
৯. সম্পদ নিসাব পরিমাণ হলে বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যাকাত দেওয়া বৈধ, বিশেষভাবে যদি তাতে গরীবদের উপকার হয়। যেমন, জানা গেল যাকাতের জনৈক হকদার অর্থাৎ আট প্রকার থেকে কেউ হঠাৎ সমস্যার সম্মুখীন বা অর্থের মুখাপেক্ষী, তাকে সময় হওয়ার আগে যাকাত দেওয়া বৈধ। আর যদি যাকাত দানকারী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়, তবে এই আশায় যাকাত দিল যে, ভবিষ্যতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার এই দান সাধারণ সদকা হবে, যাকাত হবে না।
১০. আয়াতে উল্লিখিত আটটি খাতেই যাকাত দেওয়া উত্তম, তবে কেউ যদি এক খাতে যাকাত দেয় তাতেও সমস্যা নেই। অধিকাংশ আলিম বলেছেন এ কথা, এটিই সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ।
১১. যাকাত নিজে বণ্টন করা বা বণ্টন করার দায়িত্ব অপরকে দেওয়া উভয়ই বৈধ, তবে ইবাদতের সাওয়াব হাসিল করার জন্য নিজের যাকাত নিজে বণ্টন করাই উত্তম, যেন সঠিক স্থানে আদায় করার নিশ্চিয়তা হাসিল হয়। বিশেষভাবে তার পক্ষে যাকাত আদায়কারী প্রতিনিধি সম্পর্কে যদি সম্যক ধারণা না থাকে।
১২. যাকাত বের করার সময় অন্তরে নিয়ত করা ওয়াজিব:
১৩. আলিমদের বিশুদ্ধ মতে দেশের বাইরের গরীবদের জন্য যাকাত প্রেরণ করা বৈধ, বিশেষভাবে যদি তার ধারণা হয় তার নিজের দেশের গরীব অপেক্ষা বাইরের গরীবরা যাকাত দ্বারা বেশি উপকৃত হবে। যেমন, তারা বেশি গরীব অথবা তার আত্মীয়দের থেকে বেশি গরীব অথবা তাদের যাকাত দিলে নেকি বেশি হবে, যেমন তারা ইলম হাসিল করবে। যদি অপর দেশে যাকাত প্রেরণ করায় বিশেষ ফায়দা না থাকে কাছের লোকদের দেওয়াই উত্তম। কারণ, তাদের হককে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি পূরণ হয়। দ্বিতীয়ত যাকাত অন্য জায়গায় প্রেরণ করা অপেক্ষা নিজের দেশে দেওয়া অতি সহজ ও নিরাপদ, অধিকন্তু তার যাকাতের সাথে প্রতিবেশী গরীবদের অন্তর সম্পৃক্ত, বিশেষভাবে যদি যাকাত প্রকাশ্য হয়, অতএব, তারা যাকাত পেলে তাদের মহব্বত বৃদ্ধি পাবে ও তাদের অন্তর আকৃষ্ট হবে। উল্লেখ্য যে, যাকাত স্থানান্তর করার খরচ যাকাত থেকে দেওয়া যাবে না, বরং যাকাত দানকারী নিজের পক্ষ থেকে বহন করবে।